নুর মুহাম্মদ, সেন্টমার্টিন থেকে::
ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত দালানকোঠা ও মানুষের চাপে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভাঙন ধরেছে। গত দুই দিন ধরে সমুদ্রের স্রোতে দ্বীপের চারদিকে দেখা দিয়েছে ভাঙন। দ্বীপটি দাঁড়িয়ে আছে শুধু পাথরের ওপর। অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পাথর। এছাড়া সমুদ্র সৈকত থেকে অবাধে তোলা হচ্ছে বালি। এসব কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বেশকিছু রিসোর্টের সামনের জায়গা সমুদ্রের স্রোতে ভেঙে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দ্বীপটি রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকার প্রতি বছর এ দ্বীপ থেকে কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও এটি রক্ষায় তেমন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। গত দুই দিন ধরে দ্বীপে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর আহমদ বলেন, ‘অতিরিক্ত দালানকোঠা ও মানুষের চাপে দ্বীপটি নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে। ফলে গত দুই দিন ধরে সমুদ্রের স্রোতে দ্বীপের চারদিকে ভাঙন ধরেছে। এতে দ্বীপটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দ্বীপে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে আসেন, তা থেকে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব পায়। কিন্তু দ্বীপ রক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউই।’
চেয়ারম্যান নূরের ভাষ্য, ‘হয়তো একদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে শুনবো সেন্টমার্টিন নামের দ্বীপটি আর নেই, হারিয়ে গেছে সমুদ্রে। কেননা বর্তমানে দ্বীপে পরিবেশবিরোধী এমন কাজকর্ম হচ্ছে, তা থেকেই এমন ভয়ঙ্কর আশঙ্কা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন কিছু ঘটে গেলে তা অবিশ্বাস্য কিছু হবে না।’
দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, গত দুই দিন (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) ধরে সামান্য বৃষ্টি ও সমুদ্রের স্রোতে দ্বীপের কোনারপাড়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও উত্তরপাড়ায় ভাঙন ধরেছে। এতে দ্বীপের বসতি, কেয়া বাগান, নারিকেল বাগান, নিশিন্দা বাগানসহ গাছ-গাছালি ভেঙে পড়ে গেছে। এছাড়া দ্বীপের তীরে গড়ে ওঠা হোটেল অবকাশ, ড্রিম নাইট, পান্না রিসোর্ট, নীল দিগন্ত রিসোর্ট,সমুদ্র কুটির রিসোর্ট,সীমানা পেরিয়ে রিসোর্ট, সায়রী রিসোর্ট, কিংশুক রিসোর্ট, সি ভিউ রিসোর্ট, সী প্রবাল, মারমেড রিসোর্টের সামনের জায়গাগুলো সমুদ্রের স্রোতে ভেঙে যাচ্ছে। ‘গত কয়েকদিন ধরে সমুদ্রের স্রোতে দ্বীপের কয়েকটি অংশে ব্যাপক ভাঙন ধরেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ ভাঙন এটি। তাছাড়া ২০০ বছর আগে এ দ্বীপে বাসিন্দা ছিল মাত্র ১৩ জন। বর্তমানে ৯ হাজারের বেশি মানুষ এখানে বসবাস করছেন। তার ওপরে গড়ে উঠেছে অবৈধ হোটেল-মোটেল। এছাড়া রয়েছে হাজারও পর্যটকের আনাগোনা। দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে শুধু পাথরের ওপর, সেসব পাথরও এখন ধ্বংস করা হচ্ছে। ফলে দ্বীপ নিচের দিকে দেবে সমুদ্রের স্রোতে ভেঙে যাচ্ছে। এই দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে পরিবেশবিরোধী ও অবৈধ ভবন নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। না হলে একদিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে সেন্টমার্টিন।’এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে দ্বীপ রক্ষার দাবি জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
এদিকে সরকারিভাবে সেন্টমার্টিনকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করা হলে ঠিক উল্টোপথে চলছে এ দ্বীপটি। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগ। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় সরকার এ দ্বীপকে রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পুরো দ্বীপ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে।
কক্সবাজারের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘দ্বীপ রক্ষা করতে আদালতের নির্দেশনা পালন করতে হবে। না হলে এ দ্বীপ রক্ষা করা যাবে না। এর আগে দ্বীপে গড়ে ওঠা অবৈধ ৩৮টি আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশনা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি বরং দ্বীপে নতুন করে দালানকোঠা নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান বাংলা বলেন, ‘দ্বীপে ভাঙনের বিষয়টি উদ্বেগজনক। যদিও দ্বীপ নিয়ে সরকারের নতুন পরিকল্পনা রয়েছে। তবে যেসব অবৈধ স্থাপনা রয়েছে সেগুলো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বলেন, ‘দ্বীপে ভাঙনের খবর পেয়েছি। আমরা সেখানে সরেজমিন পরিদর্শনে যাবো। তাছাড়া সেন্টমার্টিন পরিবেশগত দিক দিয়ে অতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন।’
পাঠকের মতামত: